বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নাটকীয় কালপর্বকে উপজীব্য করে লেখা প্রামান্য উপন্যাস ক্রাচের কর্নেল। এই গ্রন্থে আমি বাংলাদেশের রাজনীতির সেই ক্রান্তিকালটিকে বুঝবার চেষ্টা করেছি কর্নেল তাহের নামের একাধারে অমীমাংসিত, বিতর্কিত এবং বর্নাঢ্য চরিত্রের মাধ্যমে। উনিশশ ষাট/সত্তর দশকের পৃথিবী যখন পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক দুটো শিবিরে বিভক্ত তখন তৃতীয় বিশ্বের অগনিত তরুণ-তরুণী একটি বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ছিলো বিভোর। কর্নেল তাহের সেই প্রজন্মের তরুণ। তিনি একটি বিশেষ ধারার বিপ্লবী রাজনীতির কৌশল হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবহিনীতে, তারপর দুঃসাহসিক এক অভিযানের ভেতর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, যুদ্ধক্ষেত্রের দুর্ধর্ষ এক অপারেশনে হারিয়েছেন একটা পা, ক্রাচে ভর দিয়ে তারপর নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্যাতিক্রমী এক সেপাই অভ্যুত্থানের এবং অবশেষে শিকার হয়েছেন উপমহাদেশের ঘৃনিত এক রাজনৈতিক ফাঁসির। একটা আদর্শকে তাড়া করতে গিয়ে একজন মানুষ যতটুকু দিতে পারে দিয়েছেন সবটুকুই। যদিও সে আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু তথাকথিত বহু সাফল্যের চাইতে কোন কোন ব্যর্থতাও হয়ে উঠতে পারে উজ্জ্বল, দাবী করে আমাদের মনোযোগ। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চায় কর্নেল তাহের সচরাচর থাকেন উহ্য, উপেক্ষিত অথবা পরষ্পর বিরোধী বক্তব্যে ধোঁয়াচ্ছন্ন।
একজন লেখক হিসেবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতুহলী পর্যবেক্ষক হিসেবে এই ব্যাতিক্রমী মানুষটিকে নিয়ে একটি সাহিত্যিক মোকাবেলার ফল¯্রুতি ক্রাচের কর্নেল। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এই দেশে কর্নেল তাহেরকে ঘিরে থাকা নানা কুয়াশা সরিয়ে তার সঠিক ঐতিহাসিক বয়ানটি নির্মান করা দুরূহ কাজ। দীর্ঘ গবেষণায় সেই কালপর্ব সংক্রান্ত দলিল, লেখাপত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে কর্নেল তাহেরের রক্তমাংসের অবয়ব এবং তার যাত্রাপথটিকে বুঝবার চেষ্টা করেছি এই গ্রন্থে। অনুসন্ধান করবার চেষ্টা করেছি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের বিভিন্ন ষ্টেশনে বেড়ে ওঠা একজন ষ্টেশন মাষ্টারের ছেলে আবু তাহের কি করে একদিন ফঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করলেন, জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে! একটি স্বাপ্নিক প্রজন্মের নিঃসঙ্গ বলি কর্নেল তাহের। কিন্তু শুধু সাফল্য বা ব্যর্থতায় নয় কর্নেল তাহেরকে আমি দেখি তার আকাংখার ভেতর। বাংলাদেশের ইতিহাস নানা ক্রান্তির ভেতর দিয়ে চলেছে। আমাদের আত্মপরিচয়ের স্বার্থেই আমাদের ইতিহাসের, রাজনীতির আলোয় ছায়ায় থাকা প্রকাশ্য, প্রচ্ছন্ন নানা চরিত্র, ঘটনাকে আমাদের খুঁড়ে দেখা প্রয়োজন নানা বিতর্ককে বিবেচনায় রেখেই। ক্রাচের কর্নেল তেমন একটা প্রয়াস। এ শুধু এক কর্নেলের গল্প নয়, এ গল্প জাদুর হাওয়া লাগা আরো অনেক মানুষের, নাগরদোলায় চেপে বসা এক জনপদের, ঘোর লাগা এক সময়ের।
ক্রাচের কর্নেল যখন লিখেছি তখন এর মঞ্চ সম্ভাবনার কথা ভাবিনি। এই প্রামান্য উপন্যাসে যে ব্যাপক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, অগনিত চরিত্র, জটিল, সর্পিল রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বয়ান আছে তাকে মঞ্চের ভাষায় তুলে আনা এক দুরূহ কাজ বলেই মনে হয়েছে। সাহিত্যের পাঠক পাঠিকার তার নিজের মর্জি মাফিক ঘটনা, চরিত্রের কল্পনা করে নেবার স্বাধীনতা থাকে কিন্তু তাকে এক নির্দিষ্ট দৃশ্যভাষায় মঞ্চে উপস্থাপন নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, অভিনেত্রীর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। নাটকের দল বটতলা সেই দুরূহ চ্যালেঞ্জটি গ্রহন করেছে জেনে চমৎকৃত হয়েছি। এই নাট্যদলের সকল কলাকুশলীকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভকামনা। বটতলার ধারাবাহিক অর্জনের পথ ধরে ক্রাচের কর্নেল-এর একটি সফল মঞ্চায়ন করবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
শাহাদুজ্জামান
প্রসঙ্গ কথা
